হযরত ইসহাক ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী সারাহ-এর গর্ভজাত একমাত্র পুত্র। তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর চৌদ্দ বছরের ছোট। এই সময় সারাহর বয়স ছিল ৯০ এবং ইবরাহীমের বয়স ছিল ১০০। অতি বার্ধ্যক্যের হতাশ বয়সে বন্ধ্যা নারী সারাহ্-কে ইসহাক জন্মের সুসংবাদ নিয়ে ফেরেশতা আগমনের ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে বিবৃত করেছি। পবিত্র কুরআনে আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে এ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে সূরা হূদ ৭১-৭৩ আয়াতে, হিজর ৫১-৫৬ আয়াতে এবং যারিয়াত ২৪-৩০ আয়াতে- যা আমরা ইবরাহীমের জীবনীতে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ ইসমাঈলকে দিয়ে যেমন মক্কার জনপদকে তাওহীদের আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন, তেমনি ইসহাক্বকে নবুঅত দান করে তার মাধ্যমে শাম-এর বিস্তীর্ণ এলাকা আবাদ করেছিলেন।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় পুত্র ইসহাক্বকে বিয়ে দিয়েছিলেন রাফক্বা বিনতে বাতওয়াঈল (رفقا بنت بتوائيل )-এর সাথে। কিন্তু তিনিও বন্ধ্যা ছিলেন। পরে ইবরাহীমের খাছ দো‘আর বরকতে তিনি সন্তান লাভ করেন এবং তাঁর গর্ভে ঈছ ও ইয়াকূব নামে পরপর দু’টি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। [1] তার মধ্যে ইয়াকূব নবী হন। পরে ইয়াকূবের বংশধর হিসাবে বনু ইস্রাঈলের হাযার হাযার নবী পৃথিবীকে তাওহীদের আলোকে আলোকিত করেন। কিন্তু ইহুদী নেতাদের হঠকারিতার কারণে তারা আল্লাহর গযবে পতিত হয় এবং অভিশপ্ত জাতি হিসাবে নিন্দিত হয়। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ইসহাক্ব (আঃ) ১৮০ বছর বয়স পান। তিনি কেন‘আনে মৃত্যুবরণ করেন এবং পুত্র ঈছ ও ইয়াকূবের মাধ্যমে হেবরনে পিতা ইবরাহীমের কবরের পাশে সমাহিত হন। স্থানটি এখন ‘আল-খালীল’ নামে পরিচিত’। [2]
উল্লেখ্য যে, হযরত ইসহাক্ব (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৪টি সূরায় ৩৪টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। [3]
[1]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৮১।
[2] . আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৮৪।
[3] . যথাক্রমে সূরা বাক্বারাহ ২/১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০; আলে ইমরান ৩/৮৪; নিসা ৪/১৬৩; আন‘আম ৬/৮৪; হূদ ১১/৭১-৭৩; ইউসুফ ১২/৬; ইবরাহীম ১৪/৩৯; হিজর ১৫/৫১-৫৬=৭; মারিয়াম ১৯/৪৯-৫০; আম্বিয়া ২১/৭২-৭৩; আনকাবূত ২৯/২৭; ছাফফাত ৩৭/১১৩; ছোয়াদ ৩৮/৪৫-৪৭; যারিয়াত ৫১/২৪-৩০=৭। সর্বমোট =৩৪টি \
Copyrigh
Saffe
১০. হযরত ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)
ইসহাক্ব (আঃ)-এর দুই যমজ পুত্র ঈছ ও ইয়াকূব-এর মধ্যে ছোট ছেলে ইয়াকূব নবী হন। ইয়াকূবের অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’। (حران) যাবার পথে রাত হয়ে গেলে কেন‘আনের অদূরে একস্থানে একটি পাথরের উপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সে অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন যে, একদল ফেরেশতা সেখান থেকে আসমানে উঠানামা করছে। এরি মধ্যে আল্লাহ তাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
إنى سأبارك عليك واكثر ذريتك واجعل لك هذه الأرض ولعقبك من بعدك-
‘অতিসত্ত্বর আমি তোমার উপরে বরকত নাযিল করব, তোমার সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দেব, তোমাকে ও তোমার পরে তোমার উত্তরসূরীদের এই মাটির মালিক করে দেব’। তিনি ঘুম থেকে উঠে খুশী মনে মানত করলেন, যদি নিরাপদে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারেন, তাহ’লে এই স্থানে তিনি একটি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করবেন এবং আল্লাহ তাকে যা রূযী দেবেন তার এক দশমাংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করবেন’। অতঃপর তিনি ঐ স্থানে পাথরটির উপরে একটি চিহ্ন এঁকে দিলেন যাতে তিনি ফিরে এসে সেটাকে চিনতে পারেন। তিনি স্থানটির নাম রাখলেন, بيت إيل অর্থাৎ আল্লাহর ঘর। [2] এই স্থানেই বর্তমানে ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ অবস্থিত, যা পরবর্তীতে প্রায় ১০০০ বছর পরে হযরত সুলায়মান (আঃ) পুনর্নির্মাণ করেন। মূলতঃ এটিই ছিল ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাসের’ মূল ভিত্তি ভূমি, যা কা‘বা গৃহের চল্লিশ বছর পরে ফেরেশতাদের দ্বারা কিংবা আদম পুত্রদের হাতে কিংবা ইসহাক্ব (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়। নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণে আল্লাহ ইয়াকূব (আঃ)-কে স্বপ্নে দেখান এবং তাঁর হাতে সেখানে পুনরায় ইবাদতখানা তৈরী হয়।
ইস্রাঈলী বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াকূব হারানে মামুর বাড়ীতে গিয়ে সেখানে তিনি তার মামাতো বোন ‘লাইয়া’ (ليّا) ও পরে ‘রাহীল’ (راحيل )-কে বিবাহ করেন এবং দু’জনের মোহরানা অনুযায়ী ৭+৭=১৪ বছর মামুর বাড়ীতে দুম্বা চরান। ইবরাহীমী শরী‘আতে দু’বোন একত্রে বিবাহ করা জায়েয ছিল। পরে মূসা (আঃ)-এর শরী‘আতে এটা নিষিদ্ধ করা হয়। শেষোক্ত স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বসেরা সুন্দর পুরুষ ‘ইউসুফ’। অতঃপর দ্বিতীয় পুত্র বেনিয়ামীনের জন্মের পরেই তিনি মারা যান। তাঁর কবর বেথেলহামে (بيت لحم) অবস্থিত এবং ‘ক্ববরে রাহীল’ নামে পরিচিত। পরে তিনি আরেক শ্যালিকাকে বিবাহ করেন। ইয়াকূবের ১২ পুত্রের মধ্যে ইউসুফ নবী হন। প্রথমা স্ত্রীর পুত্র লাভী (لاوى) -এর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারূণ নবী হন। এভাবে ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশেই নবীদের সিলসিলা জারি হয়ে যায়। ইয়াকূব-এর অপর নাম ‘ইসরাঈল’ অনুযায়ী তাঁর বংশধরগণ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত হয়। হঠকারী ইহুদী-নাছারাগণ যাতে তারা ‘আল্লাহর দাস’ একথা বারবার স্মরণ করে, সেকারণ আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদেরকে ‘বনু ইস্রাঈল’ বলেই স্মরণ করেছেন।
হারান থেকে ২০ বছর পর ইয়াকূব তাঁর স্ত্রী-পরিজন সহ জন্মস্থান ‘হেবরনে’ ফিরে আসেন। যেখানে তাঁর দাদা ইবরাহীম ও পিতা ইসহাক্ব বসবাস করতেন। যা বর্তমানে ‘আল-খলীল’ নামে পরিচিত। পূর্বের মানত অনুসারে তিনি যথাস্থানে বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ নির্মাণ করেন (ঐ)।
কেন‘আন-ফিলিস্তীন তথা শাম এলাকাতেই তাঁর নবুঅতের মিশন সীমায়িত থাকে। ইউসুফ কেন্দ্রিক তাঁর জীবনের বিশেষ ঘটনাবলী ইউসুফ (আঃ)-এর জীবনীতে আলোচিত হবে। তিনি ১৪৭ বছর বয়সে মিসরে মৃত্যুবরণ করেন এবং হেবরনে পিতা ইসহাক (আঃ)-এর কবরের পাশে সমাধিস্থ হন।
উল্লেখ্য যে, হযরত ইয়াকূব (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫৭টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। [3]
ইয়াকূবের অছিয়ত:
কেন‘আন থেকে মিসরে আসার ১৭ বছর পর মতান্তরে ২৩ বছরের অধিক কাল পরে ইয়াকূবের মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তিনি সন্তানদের কাছে ডেকে অছিয়ত করেন। সে অছিয়তটির মর্ম আল্লাহ নিজ যবানীতে বলেন,
وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيْمُ بَنِيْهِ وَيَعْقُوْبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّيْنَ فَلاَ تَمُوْتُنَّ إَلاَّ وَأَنتُمْ مُّسْلِمُوْنَ - أَمْ كُنتُمْ شُهَدَآءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوْبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيْهِ مَا تَعْبُدُوْنَ مِن بَعْدِي قَالُواْ نَعْبُدُ إِلَـهَكَ وَإِلَـهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ وَإِسْحَاقَ إِلَـهاً وَّاحِداً وَّنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُوْنَ- (البقرة ১৩৩)-
‘এরই অছিয়ত করেছিল ইবরাহীম তার সন্তানদের এবং ইয়াকূবও যে, হে আমার সন্তানগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। অতএব তোমরা অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মরো না’ (বাক্বারাহ ১৩২)। ‘তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকূবের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে? যখন সে সন্তানদের বলল, আমার পরে তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বলল, আমরা আপনার উপাস্য এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক্বের উপাস্যের ইবাদত করব- যিনি একক উপাস্য এবং আমরা সবাই তাঁর প্রতি সমর্পিত’ (বাক্বারাহ ২/১৩৩)।
শুরুতে বলা হয়েছে ‘এরই অছিয়ত করেছিলেন ইবরাহীম। কিন্তু সেটা কি ছিল? আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ- (البقرة ১৩১)-
‘স্মরণ কর যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেন, আত্মসমর্পণ কর। সে বলল, আমি বিশ্বপালকের প্রতি আত্মসমর্পণ করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১৩১)। অর্থাৎ ইবরাহীমের অছিয়ত ছিল তাঁর সন্তানদের প্রতি ইসলামের। তাঁর পৌত্র ইয়াকূবেরও অছিয়ত ছিল স্বীয় সন্তানদের প্রতি ইসলামের। এজন্য ইবরাহীম তার অনুসারীদের নাম রেখেছিলেন- ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত (হজ্জ ২২/৭৮)। ইবরাহীম তাঁর অপর প্রার্থনায় মুসলিম-এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ، ‘যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত। কিন্তু যে ব্যক্তি আমার অবাধ্যতা করল, তার বিষয়ে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৬)।
বুঝা গেল যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব প্রমুখ নবীগণের ধর্ম ছিল ‘ইসলাম’। তাদের মূল দাওয়াত ছিল তাওহীদ তথা আল্লাহর ইবাদতে একত্ব। শুধুমাত্র আল্লাহর স্বীকৃতির মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাঁর বিধানের প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের মধ্যেই তার যথার্থতা নিহিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের অনুসারী হবার দাবীদার ইহুদী-নাছারাগণ তাদের নবীগণের সেই অছিয়ত ভুলে যায় এ
Saffe